গল্পের শিরোনাম
recent

একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প

স্থানঃ হিথ্রো এয়ারপোর্ট, লন্ডন।

সেদিন সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যার পর পর বৃষ্টির বেগ বাড়ল। “অবস্থা খারাপ হতে পারে” - সেই আন্দাজ করেই আমি আগেভাগে একটা ক্যাবে করে এয়ারপোর্ট চলে এসেছিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ। লাস্ট ফ্লাইটটা মিস করে ফেললাম অল্পের জন্য।

কোন একটা ব্যাবস্থা করার জন্য আধা ঘন্টা এদিক সেদিক দৌড়া দৌড়ী করলাম। কিন্তু কোন লাভ হল না। তারপর থেকে বসেই আছি। এই মুহূর্তে বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এয়ারপোর্টের কাঁচের জানালা ভেদ করে মেঘের গুম গুম আওয়াজ ভেসে আসছে কিছুক্ষণ পর পর। ফ্লাড লাইটের তীব্র আলো ছাপিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানিতে হঠাৎ হঠাৎ কালো আর নিঃসঙ্গ রানওয়েটা দেখা যাচ্ছে। অবস্থা মনে হয় বেশ খারাপ। নাহ! ভালোই ঝামেলায় পড়ে গেলাম।

অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। লাউঞ্জে বসে চারপাশ দেখতে দেখতে আমি আকাশ পাতাল ভাবা শুরু করলাম। নিজেকে কেমন যেন রোবট রোবট মনে হচ্ছে। গতকয়েকটা সপ্তাহে পুরো ইউরোপ চষে বেড়াতে হয়েছে এক্সেল মার্কেটিং অ্যান্ড লজিস্টিক এর মার্কেট সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করার কাজে। একটা ঘন্টাও সময় পাইনি বিশ্রাম নেয়ার। এখন আবার নিউ ইয়র্ক যেতে হচ্ছে। মনে হয় নতুন আরেকটা কাজ পেতে যাচ্ছি। খুশীর খবর, কিন্তু বড়ই ক্লান্ত লাগছে আমার।

চারপাশে অসংখ্য ব্যাস্ত মানুষ ছোটাছুটি করছে। এতো বড় এয়ারপোর্ট অথচ কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। দেখতে ভালোই লাগে। হঠাৎ সোহানার কথা মনে পড়ে গেল। সোহানার সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ছয়মাস আগে কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে ওর কথা মনে পড়ে। এখনো ওকে পুরোপুরি ভুলতে পারিনি। সোহানা নাকি এখন লন্ডনেই থাকে। এটাও আরেকটা অস্বস্তি। সারাক্ষণই সোহানাকে নিয়ে এলোমেলো অনেক চিন্তা ভাবনা আমার মাথায় খেলে যেতে থাকে।

নানান চিন্তা ভাবনা করতে করতে, আর আশপাশ দেখতে দেখতে আমি সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম। হঠাৎ একলোক আমাকে প্রায় চমকে দিয়ে বলল,

“ফ্লাইট কিন্তু দু’ঘন্টা লেট।”

আমি পাশ ফিরে ভদ্রলোককে একবার দেখলাম। এই লোক কখন যে আমার পাশে এসে বসেছে খেয়ালই করিনি। ভদ্রলোকের মুখ ভর্তি হুজুর টাইপ দাঁড়ি। বিদেশীদের গালে হুজুরদের মত দাঁড়ি দেখতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। তবে একে দাঁড়িতে মানিয়ে গেছে। দেখলাম তার দাঁড়ির ভেতর দিতে একটা কৌতূহলী হাসি উঁকি দিচ্ছে। আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“আমাকে বলছেন?”

“হ্যাঁ।”

“আপনিও নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন?”

লোকটা হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ নিউ ইয়র্ক, একদম ঠিক ধরেছ।” তারপর হাতটা বাড়িয়ে বলল, “আমি এঞ্জেলো। এঞ্জেলো মেরেন্ডিনো। তুমি আমাকে জন বলে ডাকতে পর। আর তুমি?”

“আমি সালমান হায়দার।।”

জনের সাথে হাত মেলালাম। একা একা অপেক্ষা করার চাইতে খারাপ কিছু আর নেই। কথা বলার জন্য একজন মানুষ পেয়ে ভালোই লাগলো।

জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু তুমি কি করে জানলে যে আমি নিউইয়র্ক যাবো?”

“টিকেট কাটার সময় আমি তোমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি খুব অস্থির হয়ে আছো বলে মনে হল। কি, গার্লফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে নাকি?”

“হা হা হা। নারে ভাই, আমার কপাল অতো ভালো না।” হাসতে হাসতেই বললাম। যদিও মনের মধ্যে কোন এক বিরহের কালো পুকুরে বিশাল এক ঢেউ খেলে গেল সবার অজান্তে।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “কেন?”

আমি আমার প্রগোইতিহাসিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”

“ওহ সরি!” জন দুঃখ প্রকাশ করে খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলো, “কিন্তু তুমি তাকে যেতে দিলে কেন?”

আমি এবার মুখ ঘুরিয়ে জনকে ভালো করে একবার দেখলাম। সে শুধু প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি। চোখে মুখে গভীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এঁকে চিনি না, নিতান্তই অপরিচিত একজন। অথচ হঠাৎ করেই এমন একটা প্রশ্ন করলো যার উত্তর দেয়ার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি। ঠিকই তো, কেন যেতে দিলাম ওকে আমি? আসলে ছয় মাস কেটে গেলেও সোহানাকে আমি সত্যিই এখনো ভুলতে পারিনি। কোন দিন পারব বলেও মনেও হয় না। আর এই অসহায় আক্ষেপে সব কিছু ভুলে থাকার জন্য নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা আপ্রাণ করছি। পারছি না। কিছুতেই পারছি না।

বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দের সাথে মেঘের চাপা গর্জন আর বিদ্যুতের চমকে ঝলসে ওঠা রাতের মনে হয় জাদুকরী কোন প্রভাব আছে। সেই জাদুর প্রভাবে এই মাত্র পরিচিত হওয়া জন-কে আমাকে মনে হল যেন বহুকালের পরিচিত। আমার মনে হল, আমার মনে অনেক প্রাচীন কথা জমে জমে পাথর হয়ে আছে আর ওর কাছে সেগুলো নিশ্চিন্তে বলে ফেলা যায়।

লাউঞ্জেই কফি খেতে খেতে আমি জনকে বললাম কেন আমি সোহানাকে যেতে দিলাম। আমার কাজ, আমার ইগো – সব কিছুই খুলে বললাম। নিজেকে অনেক হালকা লাগলো অনেক দিন পর।

জন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল আমার প্রতিটি কথা। তারপর একটু উশখুশ করে জন পকেট থেকে তার মানিব্যাগ বের করলো। মানিব্যাগের ভাঁজ খুলে আমার সামনে মেলে ধরে বলল,

“এটা আমার স্ত্রী জেনিফারের ছবি। আমি সাধারনত এই ছবিগুলো কাউকে দেখাই না। তোমাকে দেখাচ্ছি। দেখ।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। জন আর তার স্ত্রীর একসাথে তোলা তিনটা ছবি।

কি যেন নাম বলল মেয়েটার? জেনিফার, তাই না? জনের স্ত্রী নিঃসন্দেহে অত্যান্ত সুন্দরী। ছবিগুলো অনেক পুরনো, কিন্তু এই দুজন যে তীব্র ভালবাসায় জড়িয়ে আছে সেটা ছবিগুলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তৃতীয় ছবিটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। জেনিফারের সিঙ্গেল একটা ছবি, সম্ভবত অন্য কোন একটা ছবি থেকে কেটে নেয়া। জেনিফারের মুখটা হাসি হাসি কিন্তু দু’চোখে অব্যাক্ত বিষাদ মাখা। অনেকটা যেন সোহানার মতো। আমার একটু অস্বস্তি লাগলো। ওয়ালেটটা দ্রুত ফেরত দিয়ে হতাশ গলায় বললাম,

“জন, তোমার বউ পরীর মতো সুন্দরী। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তুমি কি বোঝাতে চাইছ।”

“ব্যাপারটা বুঝতে হলে তোমাকে একটা গল্প শুনতে হবে। আর গল্পটা বলা শেষ হলে আমি তোমার কাছে একটা জিনিষ চাইব। তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তুমি আমার কথা রাখবে।”

 “তোমার কথাবার্তা আমার কাছে খুবই রহস্যময় লাগছে। ব্যাপারটা কি, খুলে বল তো!”

“আগে গল্পটা শোনো, সব বুঝতে পারবে।”

“আচ্ছা বল তোমার গল্প।”

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। গল্প শোনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ।

(২)

“প্রথম দেখাতেই আমি জেনিফারের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম!” একটু লাজুক হেসে জন বলতে শুরু করে।

মজার ব্যাপার হল আমার বাবার সাথে মা-র পরিচয়ও হয় এমনই হঠাৎ করে।

২০০১ সালের জানুয়ারি মাস। তারিখটা সম্ভবত ২৮। আমার বাবা সেদিন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যান্ড দলের সাথে গিটার বাজাচ্ছিলেন। চারপাশে বিয়ের অনুষ্ঠানে আসা অজস্র মানুষের ভিড়। বেশিরভাগই খাওয়া-দাওয়ায় ব্যাস্ত, অনেকে ঝাঁক বেঁধে গল্প করছে, কেউ কেউ আবার গানের তালে দুলছিল। মঞ্চের দিকে কারো খেয়াল নেই। সেখান থেকেই প্রথম বারের মতো তিনি মাকে দেখেন। এবং সাথে সাথেই প্রেমে পড়ে যান। গান বাজানো বাদ দিয়ে তিনি পরমুহূর্তেই নিচে নেমে আসেন এবং মা-কে তার সাথে নাচার জন্য আমন্ত্রন করেন।

যৌবনে আমার বাবা অসম্ভব সুপুরুষ ছিলেন। হয়তো সেকারনেই মা সেদিন আপত্তি করতে পারেননি। এবং সেজন্য তাঁকে পস্তাতে হয়নি।

সেদিন সন্ধ্যায় পৃথিবীতে বাবার মতো সুখী মানুষ বোধহয় আর কেউ ছিল না। অনুষ্ঠান শেষে কাঁধে গিটার ফেলে হেলেদুলে আয়েস করে গান গাইতে গাইতে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে ফিরেই তিনি ঘোষণা দেন যে তিনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন। শুধু তাই না, দু’সপ্তাহ পর তিনি সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ের বাষট্টি বছর পর, এখনো তারা একজন আরেকজনকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারেন না। জীবনের কঠিনতম মুহূর্ত তারা হেসে খেলে পার করে দিয়েছেন।

আমার বাবা এবং মা দুজনেরই ক্যান্সার হয়েছিল। প্রাণঘাতী ক্যান্সারও তাদের দুর্বল করতে পারেনি। বরং তাদের ভালবাসাকে দিয়েছিল এক নতুন মাত্রা। বার্ধক্যে পৌঁছে গেলেও এখনো তারা চমৎকার প্রাণবন্ত জীবন যাপন করছেন, আজো আড্ডায় বসলে একজন আরেকজনের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠেন।

আচ্ছা, এবার আমার কথা বলি। জেনিফারের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চাকরী খুঁজতে গিয়ে। সেটা ২০০৫ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। সবেমাত্র আমার পড়ালেখা শেষ হয়েছে। মাস খানেক এদিক সেদিক ঘোরাঘুরির পর চিন্তা করলাম একটা চাকরী বাকরি খোঁজা দরকার। এক বন্ধুর রেফারেন্সে স্থানীয় একটা বারে গেলাম বারটেন্ডারের চাকরীর খোঁজখবর করতে। বারের ম্যানেজার গিবস কাকার সাথে কথা বলতে বলতেই হঠাৎই ওর দিকে দৃষ্টি পড়ে আমার।

ওর চোখে চোখ পড়তেই কি থেকে কি যেন হয়ে গেল আমার। আশেপাশের সব কিছু যেন নিমিষেই ফাঁকা হয়ে গেল। বারের দ্রুত লয়ের উদ্দাম গান, নানা বয়সী মানুষের গুঞ্জন - সব থেমে গেল। বুকের ভেতর শান্ত হয়ে বাজতে থাকা হৃদস্পন্দন ছাড়া আর কোন শব্দ সেখানে ছিল না। কোথাও কেউ নেই, শুধু আমি আর নাম না জানা এক তরুণী - যার পরিচয় আমি জানি না। জানার যেন কোন প্রয়োজন নেই। কারণ আমার সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি এঁকে বহুকাল ধরে চিনি। ওর হাসি আর প্রতিটি অভিব্যাক্তির সাথে যেন আমি পরিচিত। যেন একটা পরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে – যার মায়া ভরা দু চোখের দিকে তাকিয়ে আমি সারা জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি।

জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার তার গল্প শুরু করে।

আমাদের চারপাশ ব্যস্ত মানুষের পদচারনায় এখনো মুখর হয়ে আছে। বাইরে থেকে একটানা বৃষ্টি পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। ঝড়ের বেগ খানিকটা কমে এলেও বৃষ্টির তেজ এখনো কমেনি। জন-এর কথা শুনতে শুনতে আমিও নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য অতীতে হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভালোবাসার প্রথম প্রহরগুলো আসলেই অন্যরকম। কল্পনায় আমার আর সোহানার সেই শুরুর দিকের দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে আবার আমি জন এর গল্পে ডুবে গেলাম...

একমাস পর জেনিফার চাকরী নিয়ে ক্লিভল্যান্ড থেকে মানহ্যাটন চলে যায়। অবশ্য এর মধ্যে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তবে সব কিছু তখনো ভাসা ভাসা। আসলে শুরুতে এর চাইতে বেশী কিছু বলার মতো সাহস করে উঠতে পারিনি। জেনিফার মানহ্যাটন চলে যাবার পর অদ্ভুত এক শুন্যতা আমাকে ঘিরে ধরে। ওকে ছাড়া আর কোন কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। সারাক্ষণই ওর কথা ভাবতে ভাবতে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।

আমি আর থাকতে পারছিলাম না। নিজেকে কোন রকমে সামলে আমি নিউইয়র্ক গিয়ে হাজির হলাম। যে করেই হোক জেনিফারের কাছে আমার মনের কথা আমাকে বলতেই হবে। নিজের মনের সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে একদিন আমি ওকে আমার মনের কথা শেষমেশ বলেই ফেললাম। ভেতর থেকে একটা ভারী পাথর যেন নেমে গেল।



আমার সম্পর্কে ও কি ভাবছে সেটা ভাবতে ভাবতে অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। কিন্তু কোন কুল কিনারা করে উঠতে পারিনি।

আমার কথা শুনে জেনিফার কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমি জানি না কি ছিল সেই দৃষ্টিতে। কিন্তু সেই কয়েক মুহূর্ত পৃথিবী যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, বন্ধ হয়ে ছিল আমার হৃদপিণ্ডের গতি – থেমে ছিল সব কিছু। আর কয়েক মুহূর্ত দেরী হলে হয়তো আমি মরেই যেতাম। শেষ মুহূর্তে আমাকে অবাক করে দিয়ে জেনিফার বলে উঠলো, “ আমিও ভালোবাসি”

আহ! কি চমৎকার ছিল সে দিনটা!

এরপর আমরা টেলিফোনে প্রেম করা শুরু করলাম। দূরত্ব কোন ব্যাপার ছিল না। আর আমরা ঘন্টার পর ঘণ্টা কথা বলতাম। কথার কোন মাথা মুণ্ডু ছিল না। নানান বিষয় নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘন্টা আলাপ করে যেতাম। সময় গুলো যেন ঝড়ের বেগে উড়ে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে ওর সাথে দেখা করতে যেতাম। সে সময়গুলো ছিল সবচেয়ে মধুর।

ছয়মাস পর আমার পক্ষে আর ওর কাছ থেকে দূরে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠলো। আমি আমার সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে নিউইয়র্কে উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নিউ ইয়র্কে গিয়ে পৌছাতে পৌছাতে আমার রাত হয়ে গেল। রাতটা সেলিব্রেট করার জন্য আমি ওকে নিয়ে গেলাম আমার সবচেয়ে পছন্দের ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট ফ্রাঙ্ক এ।

রাতের খাওয়ার পর আমার মন খুব চঞ্চল হয়ে উঠলো। জেনিফারকেও আগে কখনো এমন উচ্ছল দেখিনি। আমার মনে হল আজকের রাতটা আসলেই অন্য রকম। এই রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। দেরী না করে ওর সামনে হাতে একটা গোলাপ নিয়ে এক হাঁটু গেঁড়ে বললাম, “Will you marry me?”

জেনিফার মনে হয় আমার কাছে থেকে এরকম কিছু আশা করেনি। মুহূর্তেই ওর গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। চারপাশে লাজুক ভঙ্গীতে একবার দেখে আমাকে চাপা স্বরে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “প্লীজ, চুপ কর।”

জেনিফারের কথায় এবার আমি আকাশ থেকে পড়লাম। দৃশ্যটা একবার কল্পনা করুন। সুন্দরী এক তরুণীর সামনে গোলাপ হাতে হাঁটু গেঁড়ে এক যুবক বসে আছে যে তার কিছু জামা কাপড় আর ক্যামেরা ছাড়া সবকিছু বিক্রি করে যার জন্য চলে এসেছে সে তাকে বলছে চুপ করতে। আমি ভেবে পেলাম না কি করবো। হতভম্ব হয়ে কোন রকমে পকেট থেকে বিয়ের আংটিটা বের করে ওর সামনে ধরলাম। জেনিফার আমার হাত থেকে আংটিটা না নিলে হয়তো সেদিন আমি দমবন্ধ করেই মারা যেতাম।

পরবর্তী শরতের সুন্দর এক সকালে সেন্ট্রাল পার্কে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। সেদিন ওকে এতো অপরুপ লাগছিল! যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন অপ্সরী। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি সত্যি সত্যি এই পরিপূর্ণ নারীকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, পৃথিবীতে সেদিন আমার মতো সুখী মানুষ আর কেউ ছিল না। বিয়ে উপলক্ষে সেরাতে জমজমাট একটা পার্টি হয়। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো বাবার গাওয়া "I'm in The Mood for Love." গানের তালে তালে নেচেছিলাম আমরা। অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে চলছিল আমার সারা শরীরে। হয়তো এরই নাম ভালোবাসা।

আমি আমার স্বপ্নের নারীকে বিয়ে করেছিলাম। জীবনটাকে পরিপূর্ণ লাগছিল।

বিয়ের পাঁচ মাস দেখতে দেখতে কেটে গেল। দিনগুলো কাটছিল মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে। অবশ্য মাঝে জেনিফার বেশ অসুস্থ ছিল। একটু সুস্থ হবার পর ডাক্তার দেখানো হল। জেনির কি হয়েছে সে সম্পর্কে ওরা কিছু বলল না, গম্ভীর মুখে কি সব টেস্ট দিল। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা। একদিন হঠাৎ করেই অফিসে জেনিফারের ফোন এলো। সেই দিনটার কথা আমি কখনো ভুলব না। ফোনের ভেতর থেকে ভেসে আসা জেনির সংক্ষিপ্ত আর যান্ত্রিক স্বর আজো আমি শুনতে পারি।

বিষণ্ণ স্বরে জেনিফার কেবল এতটুকুই বলল - “আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে জন। তুমি কি সেন্ট্রাল হাসপাতালে একবার আসতে পারবে?”

কথাগুলো শুনে আমার হাত পা অসার হয়ে গেল। অনুভূতিশুন্য হয়ে আমি ছুটলাম সেন্ট্রাল হাসপাতালে।

হঠাৎ করেই কেউ যেন আমাদের অনেক উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। যেন মধুর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম, স্বপ্ন ভেঙ্গে নিজেদের আমরা আবিষ্কার করলাম ক্যান্সারের নরকে। আশায় বুক বেঁধে জেনিফারের চিকিৎসা শুরু হল। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে আমাদের জীবন অদ্ভুত আর আকস্মিকভাবে বদলে যেতে লাগলো। কেউ যেন আমাদের জীবন নিয়ে নিষ্ঠুর এক খেলা শুরু করলো যে খেলার কোন নিয়ম নেই, কোন সহানুভূতি নেই, কোন শেষ নেই। বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো একসময়। অপ্রয়োজনীয় সব কিছু ছেটে ফেলা হল আমাদের জীবন থেকে।

দেখতে দেখতে বিয়ের এক বছর পার হয়ে গেল। ঠিক আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর কিছুদিন পর জেনিফারের অনকোলজিস্ট (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার) অবশেষে আমাদের জানালো যে জেনিফারের চিকিৎসা শেষ হয়েছে, ওর শরীর থেকে ক্যানসার বিদায় নিয়েছে। ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ! নিজেকে আমার কেমন যেন অবশ-বোধশক্তিবিহীন মনে হচ্ছিল আমার সেদিন। মনে হচ্ছিল যেন অজস্র মৃত্যুকে পার করে এলাম।

হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আমরা আবার আমাদের এলোমেলো হয়ে যাওয়া সংসার সাজাতে বসলাম। কিন্তু ব্যাপারটা এতোটা সহজ ছিল না। সাধারন মানুষের থেকে ততদিনে আমরা যেন অনেক আলাদা হয়ে গেছি। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বুঝে গেলাম জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমুল পরিবর্তন হয়ে গেছে। সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেছে।

আমরা কিন্তু ভেঙ্গে পড়লাম না। বরং একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরলাম বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে। জীবনের ছোট ছোট দুর্ঘটনাগুলো একেবারেই মূল্যহীন হয়ে পড়লো আমাদের কাছে। আমাদের আর মন খারাপ হতো না। জীবনটাকে নতুনভাবে সাজাতে গিয়ে আমরা খেয়াল করলাম আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আসলে আনন্দ ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আমরা তা অবহেলা করি বলে সেসব আমরা অনেক সময় খুঁজে পাইনা। তখন পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সাথে কাটানো সময়গুলো আমাদের অনেক উজ্জীবিত করে তুলত।

২০১০ সালের এপ্রিল আমাদের দুঃস্বপ্ন বাস্তবের রূপ নিল। একটি স্ক্যানের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, জেনিফারের ক্যানসার পুরোপুরি সারেনি। বরং তা আরও মহামারির মতো ছড়িয়ে পরেছে ওর যকৃত আর হাড়ে। রোগ ধরার পড়ার সাথে সাথেই ওর চিকিৎসাও শুরু হয়ে গেল। কয়েক মাস পর আমরা খেয়ার করে দেখলাম আমাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কেউই ঠিক মতো বুঝতে পারছে না জেনিফারের অসুস্থতা আসলে কতখানি খারাপ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। প্রথম দিকে যাদের পাশে পেয়েছিলাম, ধীরে ধীরে তাদের যাতায়াতও কমে যেতে লাগলো। আমাদের জীবন ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট, ঔষধ আর ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার এক গোলকধাঁধায় পরিণত হল। হঠাৎ করেই কেউ যেন আমাদের পায়ের নিচ থেকে মাটিটা সরিয়ে নিয়ে গেছে। অদ্ভুত এক ভরশুন্যতায় আমরা যেন ভেসে যাচ্ছিলাম নিয়তির নির্ধারিত গন্তব্যে।

একেক সময় আমাদের এমন অসহায় লাগতো যে আমরা বুঝতে উঠতে পারতাম না যে আমাদের কি করা উচিৎ। আমরা কোন কথা খুঁজে পেতাম না। এক সময় আমি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ছবি তুলতে শুরু করলাম। আমাদের আশা ছিল ছবিগুলো দেখে আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন আমাদের জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারবে।

এক বন্ধুর পরামর্শে জেনির অনুমতি নিয়ে ছবিগুলো আমি ইন্টারনেটে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেই। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা সাড়া পেতে শুরু করি। সাত সমুদ্র তের নদীর অপার থেকে ক্যানসার আক্রান্ত এক মহিলা ছবিগুলো দেখে আমাকে ইমেইল করেছিল। তিনি আমাদের দুজনের অকৃত্তিম ভালোবাসা আর জীবন সংগ্রামে আমাদের পথচলা দেখে নিজের ভেতর “বেঁচে থাকার” অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। ঠিক তখনই আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের মতো এমন অসংখ্য মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে – একটু খানি আশার বানী কিংবা হয়তো এই ছবিগুলোই তাদেরকে নতুনভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে।

ডিসেম্বরের ২২ তারিখ, ২০১১ – জেনির ৪০ তম জন্মদিনের ঠিক ১৬ দিন পর সকাল সাড়ে আটটায় - আমার জীবন সঙ্গী, আমার ভালোবাসা, যার জন্য সব কিছু বিকিয়ে দিতে পারতাম নির্দ্বিধায়, সেই জেনি আমাকে ছেড়ে চলে গেল।

ধাক্কাটা এভাবে আসবে আমি বুঝতে পারিনি। কথাটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি জন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে পানি। আমি মানুষের চোখের পানি দেখতে পারি না বলে চট করে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,

“জন, আই অ্যাম সরি ফর ইওর লস।”

“প্লীজ এসব কথা বোলো না। আমি জানি জেনিফার নেই। কিন্তু আমি তো বেঁচে আছি। আর আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমার মস্তিষ্কের স্মৃতিতে ঠাই নেয়া জেনি বেঁচে আছে। থাকবে।

যাই হোক, আগেই বলেছি আমাদের বিয়ের পাঁচ মাস পর জেনির টিউমারটা ধরার পড়ে। জেনির ক্যান্সার ধরা পড়ার পর আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ শেষবার ডাক্তাররা আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল যে এখন তাদের কিছুই করার নেই। কেমোথেরাপি ক্যান্সারের ছড়িয়ে পড়া সাময়িক ভাবে মন্থর করতে পারলেও সুস্থ জীবনে জেনি আর কখনোই ফিরে আসতে পারবে না।”

জন বলে চলল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলাম।

“ডাক্তার আমাদের দু’জনকে সময় দিয়ে দিয়েছিল। আর মাত্র ছয় মাস জেনিকে আমি পাশে পাবো। যেদিন এই কথাগুলো শুনি সেদিন আমরা খুব কেঁদেছিলাম। আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না আমার জেনির সাথে এমন কেন হচ্ছে। একেক সময় মনে হতো বিধাতা নামের কেউ যেন আমার কাছ থেকে জোর করে জেনিকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে; অথচ আমার কিছুই করার নেই। নিজের অক্ষমতায় আমি তখন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যেতাম। মদ খেয়ে যে কতবার ঈশ্বরকে গালাগাল করেছি তার ঠিক নেই।”

শহরের কোলাহল আমাদের দু’জনের কারোরই ভালো লাগতো না। এরপর আমরা শহর ছেড়ে রিচমন্ডে চলে আসি পাকাপাকি ভাবে। আমার দাদার কাছ থেকে পাওয়া বিশাল জায়গা নিয়ে বানানো ফার্ম হাউজ আছে ওখানে। আশেপাশে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। বাড়ির সামনে যতদূর চোখ যায় অবারিত শস্যখেত আর তারপর পাহাড়ের সারি। একাকী নিরুপদ্রবে আমরা নিজেরদের আরও নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারছিলাম।

জনের বোধহয় অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আবার বলা শুরু করলো-

এমনই একদিন রাতে আমি যথারীতি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আছি। বাড়ির সামনে সিঁড়িতে বসে কাঁদছি। তখন গভীর রাত। আকাশে মেঘ নেই বলে ফকফকা জ্যোৎস্নায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। আকাশের তারাগুলো যেন ঝিকমিক করে ডাকছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। চাঁদের নরম আলোতে বার্লি ক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাসটাকে মনে হচ্ছে দুরন্ত এক কিশোর। যার মনে কোন বেদনা নেই, কোন শঙ্কা নেই, প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় নেই। অনেক দূরে কালো পাহাড়ের সারি যেন অতন্দ্র প্রহরী।

জেনি কখন আমার পাশে এসে বসেছে আমি একদম টের পাইনি। তাই ও যখন আমার হাত ধরল তখন আমি একটু চমকে হাত সরিয়ে নিয়েছিলাম। এমন ঠাণ্ডা আর প্রাণহীন ছিল সেই স্পর্শ! ভুল বুঝতে পেরে খারাপ লাগলো। জেনি মনে হয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। ওই হাসিতেই অনেক কিছু লুকিয়ে ছিল। ওর চোখের তারায় এমন অনেক কথা ছিল যা কেবল আমিই বুঝতাম। অসম্ভব সুন্দর দুটো চোখ ছিল ওর।

জেনি আমার খুব কাছাকাছি এসে বসলো। হাতটা জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো অনেকক্ষণ। এক সময় মাথাটা একটু তুলে আমার কানে কানে বলল,

“তুমি কি জানো আমি তোমাকে অসম্ভব ভালবাসি?”

আমি জবাব দিতে পারলাম না। আমার চোখ ফেটে অশ্রুর ঢল নেমে এলো। বুকের অনেক গভীর থেকে এক হাহাকারের আলোড়ন আমার সমস্ত স্বত্বা ফুড়ে অনন্ত মহাকাশে পৌছাতে চাইলো। জেনির কোলে মাথা লুকিয়ে সেদিন অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। একাই। জেনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে শান্ত করলো। আমি ওর কোলে মাথা রেখে জ্যোৎস্নালোকিত দিগন্তের অস্পষ্ট সীমানার মাঝে কিছু একটা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম। সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল।

জেনি বলতে লাগলো, “চমৎকার জ্যোৎস্না রাত, তাই না?”

“হ্যাঁ”

“জন!”

“বল।”

“এক সময় আমাকে কিন্তু মরতেই হতো।”

আমি এক ঝটকায় উঠে বসলাম। মনের সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে বললাম, “কিন্তু এভাবে কেন?”

“এটাই নিয়ম।”

“আমি কোন নিয়ম মানি না।”

আমার ছেলেমানুষি কথা শুনে জেনি খিলখিল করে হেসে উঠলো। খুব সুন্দর ছিল ওর হাসিটা। অনেক উঁচু থেকে ঝর্নার পতনের শব্দের মাঝে যেন একটা পাখি গান গাইছে। সেই হাসির অদ্ভুত একটা বিশিষ্টও ছিল। হাসি থেমে যাবার পরও অনেকক্ষণ সেই হাসির শব্দ শোনা যেত। ডাক্তার দেখাবার পর অনেকদিন আমরা কেউ প্রাণ খুলে হাসিনি। সেই হাসিতে অনেক কিছু যেন পাল্টে গেল।

হাসি থামার পর ও আবার বলতে শুরু করলো, ধীরে কিন্তু অনেক দৃঢ় স্বরে,

“জন, আমি এভাবে তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। নিয়তির বাঁধা অতিক্রম করার সাধ্য আমাদের নেই কিন্তু আমি তার কাছে হার মানতে চাই না। আমি চাই না আমাদের ভালোবাসার এমন পরিনতি হোক। আমরা এখন থেকে সব কিছু বদলে দেব। আমরা আর কাঁদবো না। আমি চাই যেটুকু সময় আমাদের কাছে আছে সেটুকু আনন্দে কাটুক।”

তুমি এখন থেকে প্রতিদিন আমার একটা করে ছবি তুলবে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই ছবিগুলো আমাকে তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে দেবে না। আমি তোমার কাছেই থাকব। আমি তোমার মনে দুঃখের স্মৃতি হয়ে থাকতে চাই না। পারবে না?”

ওর কথাগুলো আমার বুকে শেলের মতো বিঁধল। পরদিন সকালেই আমি আর ও কাজে নেমে গেলাম। এরপর আমাদের দুজনের অসংখ্য ছবি তুলেছি আমি। সেই ছবি আর আমাদের ভালোবাসার গল্প অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে।

“দু’ বছর হয়ে গেছে ও চলে গেছে। কিন্তু একটা মুহূর্তের জন্যও আমার নিজেকে একা মনে হয়নি।“

জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকাল। এতক্ষণ আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ওর কথা শুনতে শুনতে কত সময় পার হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। ফ্লাইটের সময় হয়ে এসেছে বোধহয়। এবার উঠতেই হবে। কিন্তু ও আমার কাছে কেন এসেছিল সেটাই তো জানা হল না। আমি প্রায় মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

“কিন্তু তুমি আমার কাছে কি চাও? কিছুই তো বললে না।”

“আমি আর জেনি ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় আর্থিক সাহায্য করার জন্য একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলেছিলাম। ক’দিন পর তুমি যখন বিখ্যাত আর অনেক বড় লোক হয়ে যাবে তখন তুমি আমাদের কিছু টাকা দান করতে পারো। আপাতত তাতেই হবে।”

“আমি তো আজ আমার দেশে চলে যাচ্ছি। তোমাকে কোথায় খুঁজে পাবো আমি?

“হা হা হা! সেটা নিয়ে তুমি একদম চিন্তা করো না। তুমিই আমাকে খুঁজে বের করবে।”

“তুমি কি করে জানলে?”

“জেনি আমাকে বলেছে।”

পরিশিষ্ট

অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্পটা এখানেই শেষ। জেনিফারের ব্যাপারে এরপর আমি বহুবার জনকে জিজ্ঞেস করেছি। ও আমার প্রশ্নের কোন জবাব দেয়নি। শুধু মুচকি মুচকি হেসেছে।

দেশে ফিরে এসে আমি নিজের ব্যাবসা শুরু করি। অল্প সময়ের মধ্যেই অর্থ আর সাফল্য এসে আমার কাছে ধরা দেয়। সোহানাকেও আমি হারিয়ে যেতে দেইনি। আমার আর সোহানার ছোট্ট সংসার আলো করে দু’টি ফুটফুটে জমজ মেয়ে আছে আমাদের। ইমা আর ইরা দুই মেয়েই জন চাচার খুব ভক্ত। প্রতি বছর ক্রিসমাসে জন ওদের জন্য বিশাল বিশাল গিফটের প্যাকেট নিয়ে আসে। সারাদিন ওরা ওদের জন চাচার সাথে হৈ চৈ করে, নানান গল্প করে কাটায়। জনের সাথে ওরা এতো কি গল্প করে সেটা সোহানাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওরা নাকি বলেছে জনের কাছ থেকে জেনি আন্টির গল্প শোনে ওরা। কি সেই গল্প? আমি জানি না, সোহানাও জানে না। জিজ্ঞেস করলে ওরা মুচকি মুচকি হাসে।

দুই বোন খুব অদ্ভুত ভাবে বেড়ে উঠছে। মাঝে মাঝে ওদের আমি বুঝে উঠতে পারি না।

সেবার যখন ব্যাবসা কাজে আমি চীন যাচ্ছিলাম তখন দুই বোন আমাকে কিছুতেই বাসা থেকে বের হতে দিল না। আমার হাত ধরে ঝুলে থাকল। অগত্যা আমাকে ফ্লাইট ক্যানসেল করতে হল। চীনে যাদের সাথে মিটিং ছিল তারা আমার ব্যাবহারে খুব কষ্ট পেল। ব্যাবসায় বেশ ক্ষতি হয়ে গেল।

কিন্তু পরদিন পেপার খুলে যা দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেল। যে বিমানে করে আমার যাওয়ার কথা ছিল সেটা যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে ক্রাশ করেছিল। পাঁচ জন মারাও গেছে।

আমি দুই বোনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কি মা? আমাকে তোমরা কাল যেতে দিলে না কেন? আমার খুব ক্ষতি হয়ে গেল।

আমার কথা শুনে দুই বোন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি যেন বলল।

তারপর ইমা হাসি মুখে আমাকে বলল, “জেনি আন্টি মানা করেছিল।”

ABC

ABC

No comments:

Post a Comment

Powered by Blogger.